মুহাররম ও আশুরা
মুহাদ্দিস আব্দুল ওয়াদুদ উমায়ের (হাফিজাহুল্লাহ)
পরিবেশনায়ঃ
আল বাইয়্যিনাহ মিডিয়া
الحمد لله رب العلمين حمدا كثيرا طيبا مباركا فيه واشهد ان الا اله الا الله وحده لا شريك له واشهد ان محمدا
হিজরী বছরের প্রথম মাস হলো মুহাররম। হিজরী সন মুসলমানদের জন্য নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামের সব বিধান প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে এর সঙ্গে জড়িত। আর এ মাস যেহেতু হিজরীর সূচনা মাস, তাই এই মাসটি নতুন বছরে বিগত বছরের ত্রুটি কাটিয়ে নতুন প্রত্যয়ে নিজেদের জীবন পরিচালনার জন্য মাইলফলক। আরোও বিভিন্ন দিক বিবেচনায় এ মাসটি আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক আশুরার সিয়াম পালন ও এর ফযীলত বর্ণনার মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবেই এ মাসের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে দুঃখের বিষয় হলো রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে উদ্দেশ্যে আশুরার সিয়াম পালন করেছেন, আমরা তাঁর উদ্দেশ্যের কথা ভুলে গিয়ে এমন উদ্দেশ্যে সিয়াম পালন করছি যা কুরআন ও সুন্নাহর সম্পূর্ণ বিরোধী। সাথে সাথে এমন সব বিদ‘আতে লিপ্ত হয়েছি যা থেকে বেঁচে থাকা একান্ত জরুরি। তাই মুহাররম ও আশুরার সিয়াম সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গুরুত্বপূর্ন আলোচনা তুলে ধরা হলো।
মুহাররম মাসের ফজীলত
মুহাররম শব্দের অর্থ ‘সম্মানিত’। ইসলামের ইতিহাসে এই মাসটি কতগুলো ঘটনার জন্য উল্লেখযোগ্য এবং স্মৃতিবিজড়িত। স্মৃতিবিজড়িত ঘটনা ও মর্যাদার কারণেই মুহাররম মাসের গুরুত্ব অত্যাধিক। কুরআনুল কারিমে ও হাদীসে এ মাসকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। যেমন:
১। এটা হারাম মাস।
মুহাররম মাস হিজরী সনের প্রথম মাস। এটি ‘আশহুরে হুরুম’ তথা হারামকৃত মাস তথা মহা সম্মানিত চতুষ্টয়ের অন্যতম। আশহুরে হুরুম সম্বদ্ধে মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
, إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِنْدَ اللهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ،
আসমান-যমীন সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর কিতাবে (লৌহ মাহফুজে) মাসগুলোর সংখ্যা হল বার। তার মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস। এটা হল সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন। {সূরা ত্বওবা: ৩৬}
আবূ বাকরাহ (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
,الزَّمَانُ قَدِ اسْتَدَارَ كَهَيْئَتِهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ، السَّنَةُ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا، مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ، ثَلاَثَةٌ مُتَوَالِيَاتٌ ذُو الْقَعْدَةِ وَذُو الْحِجَّةِ وَالْمُحَرَّمُ، وَرَجَبُ مُضَرَ الَّذِى بَيْنَ جُمَادَى وَشَعْبَانَ،
‘আল্লাহ যেদিন আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন, সেদিন হতে সময় যেভাবে আবর্তিত হচ্ছিল আজও তা সেভাবে আবর্তিত হচ্ছে। বারো মাসে এক বছর। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। যুল-কা‘দাহ, যুল-হিজ্জাহ ও মুহাররাম। তিনটি মাস পর পর রয়েছে। আর একটি মাস হলো রজব-ই মুযার, যা জুমাদা ও শা‘বান মাসের মাঝে অবস্থিত’। {সহীহ বুখারী: ৩১৯৭; সহীহ মুসলিম: ১৬৭৯; আবু দাঊদ: ১৯৪৭}
মুহাররমকে মুহাররম বলে অভিহিত করা হয়েছে কারণ এটি অতি সম্মানিত মাস। আল্লাহর বাণী “তোমরা এতে নিজেদের উপর কোনো জুলুম করো না।” অর্থাৎ, এই সম্মানিত মাস সমূহে তোমরা কোনো অন্যায় করো না। কারণ এ সময়ে সংঘটিত অন্যায় ও অপরাধের পাপ অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি ও মারাত্মক।
আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, এই বারো মাসের কোনোটিতেই তোমরা অন্যায় অপরাধে জড়িত হয়ো না। অত:পর তা হতে চারটি মাসকে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করেছেন। তাদেরকে মহা সম্মানে সম্মানিত করেছেন। এসবের মাঝে সংঘটিত অপরাধকে অতি মারাত্মক অপরাধ বলে গণ্য করেছেন। আর তাতে সম্পাদিত নেক আমলকে বেশি সাওয়াব যোগ্য নেক আমল বলে সাব্যস্ত করেছেন। {সার সংক্ষেপ, তাফসির ইবনে কাসির, সূরা ত্বওবা: ৩৬}
২। আল্লাহর মাস।
এ মাসকে সহীহ হাদীসে ‘আল্লাহর মাস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং এ মাসের নফল সিয়াম সর্বোত্তম নফল সিয়াম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সহীহ মুসলিমে সংকলিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
أفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللهِ المُحَرَّمُ
আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন: “রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে আল্লাহর মাস মুহাররম (মাসের রোজা)।” {সহীহ মুসলিম: ১৯৮২}
ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, রমজান মাস অধিক ফজিলতপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও মুহাররম মাসকে আল্লাহর মাস বলে সম্বোধন করার কারণ হলো চন্দ্রমাসসমূহের মধ্যে একমাত্র মুহাররম মাসকে ইসলাম আগমনের পর নামকরণ করা হয়েছে। অন্যান্য মাসগুলো জাহেলিয়াত যুগের নামের ওপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। জাহেলিয়াত যুগে এই মাসকে বলা হতো ‘সফর আউয়াল’ এর পরের মাসকে বলা হতো ‘সফর সানী’। বর্তমানে যাকে সফর মাস বলা হয়। {শরহে মুসলিম, ইমাম সুয়ূতী, তৃতীয় খণ্ড,পৃষ্ঠা: ২৫১}
৩। সর্বোত্তম মাস।
রমজানের পর শ্রেষ্ঠ মাস হল মুহাররম মাস।
হাদীসে এসেছে,
حديث أبي ذر رضي الله عنه_ قال:” سألت النبي صلى الله عليه وسلم: أي الليل خير وأي الأشهر أفضل؟ فقال: “خير الليل جوفه، وأفضل الأشهر شهر الله الذي تدعونه المحرم”
আবু যর (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে জিজ্ঞাসা করলাম রাতের কোন অংশটি উত্তম আর কোন মাসটি উত্তম ? রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন মধ্য রাত উত্তম আর শ্রেষ্ঠ মাস হচ্ছে আল্লাহর মাস, যাকে তোমরা মুহাররম বলে থাক। {সুনানে কুবরা, নাসাঈ}
হজরত ইবনে রজব হাম্বলী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, সম্মানিত মাসসমূহের মধ্যে কোনটি উত্তম তা নিয়ে ওলামায়ে কেরামগণ বিভিন্ন মত দিয়েছেন। হজরত হাসান বসরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এই মাসগুলোর মধ্যে উত্তম হলো মুহাররম। তিনি আরোও বলেন, “আল্লাহ তা’আলা সম্মানিত মাস দিয়ে বছর শুরু করেছেন এবং সম্মানিত মাস দিয়ে শেষও করেছেন। রমজানের পর উত্তম মাস হলো মুহাররম। অত্যধিক সম্মানের কারণে এটিকে বধির মাস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে” {লতায়েফুল মায়ারিফ, পৃষ্ঠা: ৭৭,৭৮}
আশুরা দিবসে সিয়াম পালনের ইতিহাস
মুহাররম মাসের সবচেয়ে মহিমান্বিত দিন হচ্ছে ‘আশুরা দিবস’ তথা মুহাররমের দশ তারিখ। এ দিনে সিয়াম পালনের ইতিহাস সম্পর্কে ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) বর্ণনা করেছেন, এটি সেই দিন যাতে নূহ (আলাইহিস সালাম) এর কিশতি জুদি পর্বতে স্থির হয়েছিল, তাই নূহ (আলাইহিস সালাম) আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ার্থে সেদিন সিয়াম রেখেছিলেন।
আল্লাহ তায়ালা মুসা (আলাইহিস সালাম) ও তার সম্প্রদায়কে এই দিন জালেম ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তিদান করেছিলেন। যে কারণে মুসা (আলাইহিস সালাম) সিয়াম পালন করেছিলেন। যার ফলে ইহুদীরাও সিয়াম পালন করত। যেমন সহীহ বুখারিতে এসেছে, ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদিনায় আগমন করে দেখতে পেলেন যে, ইহুদিরা আশুরার দিবসে সিয়াম পালন করে।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার? (তোমরা এদিনে সিয়াম পালন করছো কেন?) তারা বললো,
هَذَا يَوْمٌ عَظِيمٌ أَنْجَى اللهُ فِيْهِ مُوْسَى وَقَوْمَهُ وَغَرَّق فِرْعَوْنَ وَقَوْمَهُ فَصَامَهُ مُوْسَى شُكْرًا فَنَحْنُ نَصُوْمُهُ. فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَنَحْنُ أَحَقُّ وَأَوْلَى بِمُوْسَى مِنْكُمْ. فَصَامَهُ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ
এটা অতি উত্তম দিন। এই দিনে আল্লাহ তা’আলা বনি ইসরাইলকে তাদের শত্রুর কবল থেকে মুক্তি দান করেছেন। ফলে এই দিনে মুসা (আলাইহিস সালাম) সিয়াম পালন করেছেন। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, মুসা (আলাইহিস সালাম) এর অনুসরণের ক্ষেত্রে আমি তোমাদের অপেক্ষা অধিক হকদার। এরপর তিনি এ দিনে সিয়াম পালন করলেন এবং (অন্যদেরকেও) সিয়াম পালনের নির্দেশ দিলেন। {সহীহ বুখারি: ২০০৪; সহীহ মুসলিম: ১১৩০}
ইসলামপূর্ব আরব জাহেলি সমাজেও এই দিনের বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা ছিল। যেমন সুনানে আবু দাউদের হাদিসে এসেছে, ‘আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মূর্খতার যুগে কুরাইশরা আশুরা দিবসে সিয়াম পালন করতো। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেও তখন (নফল হিসাবে) এ সিয়াম পালন করতেন। এরপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মদিনায় আসলেন, তখন তিনি (ফরজ হিসেবে) আশুরার সিয়াম রাখলেন এবং (সাহাবিদেরকেও) এই সিয়াম পালনের আদেশ দিলেন। এরপর যখন রমজানের সিয়াম ফরজ করা হলো, তখন তা আবশ্যক হয়ে গেল। ফলে আশুরার সিয়ামের আবশ্যকীয়তা রহিত হয়ে গেল। অতএব, যার ইচ্ছা সে এ সিয়াম পালন করবে এবং যার ইচ্ছা সে পরিত্যাগ করবে। {সুনানে আবু দাউদ: ২৪৪২}
সহীহ বুখারির এক বর্ণনায় উম্মুল মু’মিনিন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা) বলেছেন, (জাহেলি সমাজে) লোকেরা রমজানের সিয়াম ফরজ হওয়ার পূর্বে আশুরার দিনে সিয়াম পালন করতো। এ দিন কাবায় গিলাফ জড়ানো হতো। এরপর যখন রমজানের সিয়াম ফরজ হলো, তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, যে এ দিন সিয়াম পালন করতে চায় সে পালন করুক। যে না চায় না করুক। {সহীহ বুখারি: ১৫৯২}
ইহুদী ও নাসারারা শুধুমাত্র ১০ই মুহাররমকে সম্মান করত এবং সিয়াম পালন করত। তাই রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের সাথে ভিন্নতা রাখার জন্য ঐ দিন এবং তার পূর্বের অথবা পরের দিন সহ সিয়াম পালনের নির্দেশ দিলেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
حِيْنَ صَامَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَوْمَ عَاشُوْرَاءَ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّهُ يَوْمٌ تُعَظِّمُهُ الْيَهُوْدُ وَالنَّصَارَى. فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَإِذَا كَانَ الْعَامُ الْمُقْبِلُ إِنْ شَاءَ اللهُ صُمْنَا الْيَوْمَ التَّاسِعَ قَالَ فَلَمْ يَأْتِ الْعَامُ الْمُقْبِلُ حَتَّى تُوُفِّىَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم-
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন আশুরার সিয়াম পালন করলেন এবং সিয়াম পালনের নির্দেশ দিলেন, তখন সাহাবায়ে কেরাম রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! ইহুদী ও নাসারাগণ এই দিনটিকে (১০ই মুহাররম) সম্মান করে। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘আগামী বছর বেঁচে থাকলে ইনশাআল্লাহ আমরা ৯ই মুহাররম সহ সিয়াম রাখব’। রাবী বলেন, কিন্তু পরের বছর মুহাররম আসার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়ে যায়। {সহীহ মুসলিম: ১১৩৪}
আশুরা সিয়ামের ফযীলত
আরবী ‘আশারা’ (عشر) শব্দ থেকে এসেছে ‘আশুরা’ (عاشوراء)। ‘আশারা’ অর্থ দশ আর ‘আশুরা অর্থ দশম অর্থাৎ মাসের দশম দিন। হিজরী সনের প্রথম মাস মুহাররমের দশ তারিখকে আশুরা বা আশুরায়ে মুহাররম বলা হয়। আশুরার সিয়ামের কিছু ফজীলত বর্ণনা করা হলো:
১। রমজান মাসের সিয়ামের পর সর্বোত্তম সিয়াম।
রমজান মাসের সিয়ামের পর সর্বোত্তম সিয়াম হল মুহাররম মাসের সিয়াম। হাদীসে এসেছে,
حَدَّثَنَا أَبُو بَكْرِ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ، وَعَمْرٌو النَّاقِدُ، جَمِيعًا عَنْ سُفْيَانَ، – قَالَ أَبُو بَكْرٍ حَدَّثَنَا ابْنُ عُيَيْنَةَ، – عَنْ عُبَيْدِ اللَّهِ بْنِ أَبِي يَزِيدَ، سَمِعَ ابْنَ عَبَّاسٍ، – رضى الله عنهما – وَسُئِلَ عَنْ صِيَامِ، يَوْمِ عَاشُورَاءَ . فَقَالَ مَا عَلِمْتُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم صَامَ يَوْمًا يَطْلُبُ فَضْلَهُ عَلَى الأَيَّامِ إِلاَّ هَذَا الْيَوْمَ وَلاَ شَهْرًا إِلاَّ هَذَا الشَّهْرَ يَعْنِي رَمَضَانَ .
আবূ বকর ইবনু আবূ শায়বাহ ও আমর আন নাকিদ (রাহিমাহুমুল্লাহ) … উবায়দুল্লাহ ইবনু আবূ ইয়াযীদ (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইবনু আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) কে আশুরার দিনে সিয়াম পালন করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার পর তিনি বললেন, এ দিন ব্যতীত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোনো মাসকে অন্য মাসের তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করে সিয়াম পালন করেছেন বলে আমার জানা নেই। {সহীহ মুসলিম, আন্তর্জাতিক ১১৩২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২৫২৯, ইসলামিক সেন্টার ২৫২৮}
يِّ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، – رضى الله عنه – قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم “ أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللَّهِ الْمُحَرَّمُ وَأَفْضَلُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ صَلاَةُ اللَّيْلِ ” .
আবূ হুরায়রাহ (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: রমযানের সিয়ামের পর সর্বোত্তম সিয়াম হচ্ছে আল্লাহর মাস মুহাররমের সিয়াম এবং ফরয সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হচ্ছে রাতের সালাত। {সহীহ মুসলিম, আন্তর্জাতিক ১১৬২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২৬২২, ইসলামীক সেন্টার ২৬২১}
২। এক বছরের গুনাহ মাফ।
মুহাররম মাসের সিয়াম পালন করলে অতীতের এক বছরের গুনাহ মাফ হয়।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
وَصِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللَّهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ
আর আশুরার সিয়াম সম্পর্কে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে, তাতে পূর্ববর্তী বছরের গুনাহসমূহের কাফফারা হয়ে যাবে। {সহীহ মুসলিম: ১১৬২; মিশকাত: ২০৪৪; ঐ বঙ্গানুবাদ: ১৯৪৬}
এটি আমাদের প্রতি মহান আল্লাহর অপার করুণা। তিনি দুটি মাত্র দিনের রোজার মাধ্যমে পূর্ণ এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেন। সত্যই মহান আল্লাহ পরম দাতা।
ইমাম নববি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আশুরার রোজা সকল সগিরা গুনাহের কাফ্ফারা। অর্থাৎ এ রোজার কারণে মহান আল্লাহ কবিরা নয় বরং (পূর্ববর্তী একবছরের) যাবতীয় সগিরা গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। এর পর তিনি বলেন, আরাফার রোজা দুই বছরের (গুনাহের জন্য) কাফ্ফারা, আশুরার রোজা এক বছরের জন্য কাফ্ফারা, যার আমীন ফেরেশতাদের আমীনের সাথে মিলে যাবে তার পূর্ববর্তী গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে… হাদিসে বর্ণিত এসব গুনাহ মাফের অর্থ হচ্ছে, ব্যক্তির আমলনামায় যদি সগিরা গুনাহ থেকে থাকে তাহলে এসব আমল তার গুনাহের কাফ্ফারা হবে অর্থাৎ আল্লাহ তার সগিরা গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর যদি সগিরা-কবিরা কোনো গুনাহই না থাকে তাহলে এসব আমলের কারণে তাকে সাওয়াব দান করা হবে, তার দরজাত বুলন্দ করা হবে। আর আমলনামায় যদি শুধু কবিরা গুনাহ থাকে সগিরা নয় তাহলে আমরা আশা করতে পারি, এসব আমলের কারণে তার কবিরা গুনাহসমূহ হালকা করা হবে। {আল-মাজমূ শারহুল মুহাযযাব, ষষ্ঠ খন্ড, সওমু য়াওমি আরাফা}
আশুরার সিয়াম পালনের উদ্দেশ্য
১০ই মুহাররম তারিখে অত্যাচারী পাপিষ্ঠ ফেরাউন ও তার ক্বওম আল্লাহর প্রিয় নবী মূসা (আলাইহিস সালাম) কে হত্যার ঘৃণিত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে ফেরাউনের সাগরডুবি হয় এবং মূসা (আলাইহিস সালাম) ও তাঁর সম্প্রদায় বনি ইসরাইল, আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ রহমতে অত্যাচারী ফেরাউনের হাত থেকে মুক্তিলাভ করে। মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَ اِذۡ نَجَّیۡنٰکُمۡ مِّنۡ اٰلِ فِرۡعَوۡنَ یَسُوۡمُوۡنَکُمۡ سُوۡٓءَ الۡعَذَابِ یُذَبِّحُوۡنَ اَبۡنَآءَکُمۡ وَ یَسۡتَحۡیُوۡنَ نِسَآءَکُمۡ ؕ وَ فِیۡ ذٰلِکُمۡ بَلَآ ءٌ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ عَظِیۡمٌ – وَ اِذۡ فَرَقۡنَا بِکُمُ الۡبَحۡرَ فَاَنۡجَیۡنٰکُمۡ وَ اَغۡرَقۡنَاۤ اٰلَ فِرۡعَوۡنَ وَ اَنۡتُمۡ تَنۡظُرُوۡنَ –
আর স্মরণ কর, যখন আমি তোমাদেরকে ফির‘আউনের দল থেকে রক্ষা করেছিলাম। তারা তোমাদেরকে কঠিন আযাব দিত। তোমাদের পুত্র সন্তানদেরকে যবেহ করত এবং তোমাদের নারীদেরকে বাঁচিয়ে রাখত। আর এতে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে ছিল মহা পরীক্ষা। আর যখন তোমাদের জন্য আমি সমুদ্রকে বিভক্ত করেছিলাম, অতঃপর তোমাদেরকে নাজাত দিয়েছিলাম এবং ফির‘আউন দলকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম, আর তোমরা দেখছিলে। {সূরা বাকারা: ৪৯-৫০}
তার শুকরিয়া হিসাবে মূসা (আলাইহিস সালাম) এ দিন নফল সিয়াম রাখেন। মূসা (আলাইহিস সালাম) এর তাওহীদী আদর্শের সনিষ্ঠ অনুসারী হিসাবে স্বয়ং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ দিনে নফল সিয়াম পালন করেছেন এবং তাঁর উম্মতকে পালন করতে বলেছেন। ইহুদীরা কেবল ১০ তারিখে সিয়াম রাখত। তাই তাদের বিরোধিতার লক্ষ্যে তার আগের অথবা পরের দিনকে যোগ করার কথা রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন। হাদীসে এসেছে,
আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় হিজরত করে ইহুদীদেরকে আশুরার সিয়াম রাখতে দেখে কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন,
هَذَا يَوْمٌ عَظِيمٌ أَنْجَى اللهُ فِيْهِ مُوْسَى وَقَوْمَهُ وَغَرَّقَ فِرْعَوْنَ وَقَوْمَهُ فَصَامَهُ مُوْسَى شُكْرًا فَنَحْنُ نَصُوْمُهُ. فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَنَحْنُ أَحَقُّ وَأَوْلَى بِمُوْسَى مِنْكُمْ. فَصَامَهُ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ
“এটি একটি মহান দিন। এদিনে আল্লাহ মূসা (আলাইহিস সালাম) ও তাঁর ক্বওমকে নাজাত দিয়েছিলেন এবং ফেরাউন ও তার লোকদের ডুবিয়ে মেরেছিলেন। তাঁর শুকরিয়া হিসাবে মূসা (আলাইহিস সালাম) এ দিন সিয়াম পালন করেন। তাই আমরাও এ দিন সিয়াম পালন করি। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তোমাদের চাইতে আমরাই মূসা (আলাইহিস সালাম) এর (আদর্শের) অধিক হকদার ও অধিক দাবীদার। অতঃপর তিনি সিয়াম রাখেন ও সকলকে রাখতে বলেন।” {সহীহ মুসলিম: ১১৩০}
উপরোক্ত আলোচনায় মুহাররম মাসের সিয়াম পালনের উদ্দেশ্য সহীহ হাদীস দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো। আর তা হলো, অত্যাচারী শাসক ফেরাউনের কবল থেকে মূসা (আলাইহিস সালাম) এর নাজাতের শুকরিয়া স্বরূপ ৯ ও ১০ই মুহাররম অথবা ১০ ও ১১ই মুহাররম সিয়াম পালন করা।
বর্তমান সমাজে উক্ত দু’টি সিয়াম পালনের প্রচলন রয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই শাহাদতে হুসাইনের শোক পালনের উদ্দেশ্যেই তা পালিত হয়ে থাকে। যা সম্পূর্ণরূপে সহীহ হাদীস বিরোধী এবং স্পষ্ট বিদ‘আত। কেননা এই সিয়ামের সূচনা হয়েছে মূসা (আলাইহিস সালাম) এর সময় থেকে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর জীবদ্দশাতেই মুহাররমের সিয়াম পালন করেছেন। আর কারবালার ঘটনা ঘটেছে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মৃত্যুর ৫০ বছর পরে ৬১ হিজরীতে। তাহলে কি করে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) এর শাহাদতের কারণে এই সিয়াম পালন করলেন? অতএব এসব শুধুই নিছক ভিত্তিহীন কথা মাত্র। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আশুরার সিয়াম পালন করেছিলেন অত্যাচারী শাসক ফেরাউনের কবল থেকে মূসা (আলাইহিস সালাম) এর নাজাতের আনন্দে আল্লাহর শুকরিয়া স্বরূপ।
পক্ষান্তরে আমরা আজ তা পালন করছি হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) এর শাহাদতের শোক স্বরূপ। অথচ উমর (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু), উসমান (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) সহ আরোও অনেক সাহাবী শাহাদত বরণ করেছিলেন। আমরা তো তাঁদের স্মরণে কিছুই করি না!
সুতরাং এ সিয়াম পালন হতে হবে একমাত্র ফেরাউনের কবল থেকে মূসা (আলাইহিস সালাম) এর নাজাতের শুকরিয়া স্বরূপ। শাহাদতে হুসাইনের শোক বা মাতম স্বরূপ কখনোই নয় ।
মুহাররম মাসের সুন্নাতী আমল
মুহাররম মাসের সুন্নাতী আমল সম্পর্কে সহীহ হাদিসসমূহে যা বর্ণিত হয়েছে তা হলো আশুরার সিয়াম পালন করা। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ১০ই মুহাররমে সিয়াম পালন করেছেন। ইহুদী ও নাসারারা শুধুমাত্র ১০ই মুহাররমকে সম্মান করত এবং সিয়াম পালন করত। তাই রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের বিরোধিতা করার জন্য ঐ দিন এবং তার পূর্বের অথবা পরের দিন সহ সিয়াম পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব সুন্নাত হলো, ৯ ও ১০ই মুহাররম অথবা ১০ ও ১১ই মুহাররমে সিয়াম পালন করা।
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
حِيْنَ صَامَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَوْمَ عَاشُوْرَاءَ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّهُ يَوْمٌ تُعَظِّمُهُ الْيَهُوْدُ وَالنَّصَارَى. فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه و سلم فَإِذَا كَانَ الْعَامُ الْمُقْبِلُ إِنْ شَاءَ اللهُ صُمْنَا الْيَوْمَ التَّاسِعَ قَالَ فَلَمْ يَأْتِ الْعَامُ الْمُقْبِلُ حَتَّى تُوُفِّىَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم-
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন আশুরার সিয়াম পালন করলেন এবং সিয়াম পালনের নির্দেশ দিলেন, তখন সাহাবায়ে কেরাম রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! ইহুদী ও নাসারাগণ এই দিনটিকে (১০ই মুহাররম) সম্মান করে। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘আগামী বছর বেঁচে থাকলে ইনশাআল্লাহ আমরা ৯ই মুহাররম সহ সিয়াম রাখবো’। রাবী বলেন, কিন্তু পরের বছর মুহাররম আসার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়ে যায়। {সহীহ মুসলিম: ১১৩৪}
অন্য হাদীসে এসেছে, ইবনু আববাস (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
صُوْمُوْا يَوْمَ عَاشُوْرَاءَ وَخَالِفُوْا فِيْهِ الْيَهُوْدَ صُوْمُوْا قَبْلَهُ يَوْماً أَوْ بَعْدَهُ يَوْماً-
তোমরা আশুরার দিন সিয়াম রাখ এবং ইহুদীদের বিরোধিতা কর। তোমরা আশুরার সাথে তার পূর্বে একদিন বা পরে একদিন সিয়াম পালন কর। {বায়হাক্বী ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা: ২৮৭}
বিঃদ্রঃ অত্র রেওয়ায়াতটি ‘মারফূ’ হিসাবে সহীহ নয়, তবে ‘মওকূফ’ হিসাবে ‘সহীহ’। {সহীহ ইবনু খুযায়মা: ২০৯৫}
আশুরায় উদযাপিত কিছু শিরক ও বিদ‘আত
১। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা।
আশুরার দিন লোকেরা সুরমা লাগানো, গোসল করা, মেহেদি লাগানো, মুসাফাহা করা, খিচুড়ি রান্না করা, আনন্দ উৎসবসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করে থাকে, এ সম্বন্ধে শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) কে প্রশ্ন করা হলো, এর কোনো ভিত্তি আছে কি না? জবাবে তিনি বললেন, এসব অনুষ্ঠানাদি উদযাপন প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে সহীহ কোনো হাদিস বর্ণিত হয়নি এবং সাহাবাদের থেকেও না। চার ইমামসহ নির্ভরযোগ্য কোনো আলেমও এসব কাজকে সমর্থন করেননি। কোনো মুহাদ্দিস এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ও সাহাবাদের থেকে কোনো সহীহ কিংবা জয়িফ হাদিসও বর্ণনা করেননি। তাবিয়ীদের থেকেও কোনো আছর পাওয়া যায়নি। পরবর্তী যুগে কেউ কেউ কিছু বানোয়াট ও জাল হাদিস বর্ণনা করেছে যেমন,
‘যে ব্যক্তি আশুরার দিন সুরমা লাগাবে সে ব্যক্তি সে বছর থেকে চক্ষুপ্রদাহ রোগে আক্রান্ত হবে না’।
‘যে ব্যক্তি আশুরার দিন গোসল করবে সে সেই বছর থেকে আর রোগাক্রান্ত হবে না।’
এরূপ অনেক হাদীস রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় তারা একটি মওজু হাদীস বর্ণনা করেছে। যা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সালল্লাম) এর প্রতি মিথ্যারোপ ব্যতীত আর কিছুই নয়। হাদীসটি হচ্ছে, অর্থাৎ যে ব্যক্তি আশুরার দিন নিজ পরিবারের উপর উদার হাতে খরচ করবে আল্লাহ তা’আলা সারা বছরের জন্য তাকে সচ্ছলতা দান করবেন। এ ধরণের সবগুলো বর্ণনা মিথ্যা ও জাল।
২। মাতম করা।
আশুরার দিনকে কেন্দ্র করে অনেকে ‘হায় হোসেন’ ‘হায় হোসেন’ বলে বিলাপ করেন, বুক চাপড়ায় ও মাথায় কালো কাপড় বেঁধে শোক প্রকাশ করে, অশুরার দিন অনেকে হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) এর মৃত্যুকে স্মরণ করে, তার শোকে বিভিন্ন ধারালো জিনিস দিয়ে নিজের দেহকে আঘাত করে রক্তাক্ত করে এবং নিজের গায়ের কাপড় ছিঁড়ে ফেলে। এটা ইসলাম সমর্থন করে না। আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেছেন,
,لَيْسَ مِنَّا مَنْ ضَرَبَ الْخُدُودَ وَشَقَّ الْجُيُوبَ وَدَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ
‘যারা শোকে মুখে চপেটাঘাত করে, জামা ছিন্ন করে ও জাহিলী যুগের মত চিৎকার করে, তারা আমাদের দলভুক্ত নয়’। {সহীহ বুখারী: ১২৯৭}
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরোও বলেছেন,
أَنَا بَرِىْءٌ مِمَّنْ حَلَقَ وَصَلَقَ وَخَرَقَ، ‘
‘আমি তার সাথে সম্পর্কহীন যে মাথার চুল ছিঁড়ে, উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করে এবং জামার গলা ফাঁড়ে’ {সহীহ মুসলিম: ১০৪; নাসাঈ: ১৮৬৩; ইবনু মাজাহ: ১৫৮৬; মিশকাত: ১৭২৬}
৩। হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) এর মৃত্যুবার্ষিকী পালন।
কোন মুসলমান মৃত্যুবরণ বা শাহাদতবরণ করলে তার জন্য মৃত্যুবার্ষিকী পালনের বিধান ইসলামে নেই। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবায়ে কেরাম কখনো কারো জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেননি। হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) এর শাহাদত বরণের মর্মান্তিক ঘটনাটিও আশুরার দিনে অর্থাৎ ১০ই মুহাররমে ঘটেছিল। যা মুসলমানদের জন্য নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। কিন্তু এর জন্য সেদিন শোক দিবস হিসাবে পালন করা শরী‘আত সম্মত নয়।
নবী করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন
, لاَ يَحِلُّ لاِمْرَأَةٍ تُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ أَنْ تُحِدَّ عَلَى مَيِّتٍ فَوْقَ ثَلاَثٍ، إِلاَّ عَلَى زَوْجٍ، فَإِنَّهَا تُحِدُّ عَلَيْهِ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَعَشْرًا،
‘যে স্ত্রীলোক আল্লাহ এবং ক্বিয়ামাত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে তার পক্ষে স্বামী ব্যতীত অন্য কোন মৃত ব্যক্তির জন্য তিন দিনের বেশী শোক পালন করা বৈধ নয়। অবশ্য স্বামীর জন্য সে চার মাস দশ দিন শোক পালন করবে’। {সহীহ বুখারী: ১২৮০, সহীহ মুসলিম: ১৪৮৬}
কোন মুসলিম ব্যক্তি মারা গেলে তার মৃত্যুতে সর্বোচ্চ তিন দিন শোক পালন করা যাবে, যদিও তারা পিতা-মাতা, ছেলে-মেয়ে, ভাই বোন হয়। তবে স্ত্রী স্বামীর জন্য চার মাস দশ দিন শোক পালন করবেন এবং বিবাহ, সাজগোজ থেকে বিরত থাকবেন. {সূরা বাকারা: ২৩৪}
৪। তা‘যিয়া করা।
তা‘যিয়া শব্দের অর্থ- সান্ত্বনা দান, শোক প্রকাশ। আশুরার দিন হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) এর কাল্পনিক কবর তৈরী করে তা‘যিয়া বা শোক মিছিল করা হয়। ঐ ভুয়া কবরগুলিকে ‘আত্মা সমূহের অবতরণস্থল’ বলে ধারণা করা হয়। সেখানে সিজদা করা হয়, মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য প্রার্থনা করা হয়। সেখানে হুসাইনের রূহ হাযির হয় কল্পনা করে তাকে সালাম দেওয়া হয়। তার সামনে মাথা ঝুঁকানো হয়। এগুলো স্পষ্ট শিরক।
৫। মর্ছিয়া করা।
মর্ছিয়া (المرثية) আরবী শব্দ। এর অর্থ- শোকগাথা, শোকসঙ্গীত। আমাদের সমাজে কারবালার ইতিহাসকে নিয়ে বিভিন্ন রকম কবিতা, জারী গান, বিভিন্ন নভেল-নাটক ও গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে। যার অধিকাংশ ভিত্তিহীন ও মনগড়া। ইসলামে মৃত ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে এসকল কার্যকলাপ কখনো জায়েয নয়। বরং তাদের এ শাহাদাতের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে যে, আমরা কখনও বাতিলের সামনে আমাদের মাথা নত করব না যদিও আমাদেরকে শহীদ হতে হয়।
উপসংহার
মুহাররম মাসে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কি করেছেন আর আমরা কি করছি তা মিলিয়ে দেখতে হবে পবিত্র কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর সাথে। কারবালার ঘটনা সম্পর্কে সকল প্রকার আবেগ ও বাড়াবাড়ি হতে দূরে থাকতে হবে এবং আশুরা উপলক্ষে প্রচলিত শিরক ও বিদ‘আতী আক্বীদা-বিশ্বাস ও রসম-রেওয়াজ পরিহার করতে হবে আর সুন্নাহ মোতাবেক আমল করতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে বিদ‘আত মুক্ত জীবন-যাপন করার তওফীক্ব দান করুন- আমীন.
سُبْحَانَكَ اللّٰهُمَّ وَبِحَمْدِكَ اَشْهَدُ أَنْ لَا إِلٰهَ إِلَّا أَنْتَ اَسْتَغْفِرُكَ وَاَتُوْبُ اِلَيْكَ
COMMENTS
ألسلام عليكم ورحمة الله وبركاته
আলহামদুলিল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
আপনারা কেমন আছেন ভাই?
ভাই আমার আল্লাহ আপনাদেরকে হেফাজতে রাখুন আমিন।