হাসিনার ফাঁসির রায়: লুকিয়ে রাখা একটি বাস্তবতা

Homeবার্তা ও বিবৃতিFeatured

হাসিনার ফাঁসির রায়: লুকিয়ে রাখা একটি বাস্তবতা

যাবতীয় প্রশংসা সেই মহান রবের জন্য যিনি তার পবিত্র কিতাবকে সম্মানিত করেছেন, পরিপূর্ণ করেছেন এবং সমগ্র মানবজাতির হিদায়াতের জন্য নাযিল করেছেন। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর উপর, তাঁর পরিবার-পরিজন, সাহাবায়ে কেরাম এবং কিয়ামত পর্যন্ত যারা তাঁর দেখানো হেদায়েতের পথে চলবে, তাদের সকলের উপর।

বাংলাদেশের বিগত তাগুত সরকার প্রধান, অসংখ্য গুম-খুনের বৈধতা দানকারী, নব্য ফেরাউন খ্যাত হাসিনার ফাঁসির রায় এসেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশ এর পক্ষ থেকে। যাকে তাগুতি আদালতের তথাকথিত আইনের সর্বোচ্চ ন্যায়(?) বিচার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। পুরো দেশ যেন উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যারা সরাসরি এতদিন কোনো না কোনো ভাবে এই স্বৈরশাসনের জুলুমের শিকার হয়েছিলেন, তারা অনেকেই আজ ভাবছেন তাদের সাথে ইনসাফ করা হয়েছে। আল্লাহর প্রতি ইমান রাখে, এরকম মানুষগুলোও কেন যেন এই রায়ে অত্যন্ত সন্তুষ্টি প্রকাশ করছেন। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি – হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী ব্যক্তিরা যাদের অনেকেই নিজের প্রাণ হারিয়েছেন, যাদের অনেকেই নিজের পরিবার হারিয়েছেন, যাদের অনেকেই নিজের সর্বস্ব হারিয়েছেন, যাদের মধ্যে অনেককেই কারাগারে কাটাতে হয়েছে বছরের পর বছর, এছাড়াও জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহত হওয়া হাজার হাজার মানুষের জীবনের মূল্য একদিকে আর বিপরীত দিকে কিছু শাসকের ফাঁসির রায়, এটা কি কোনোভাবে ইনসাফ হতে পারে? নাকি ইনসাফের নামে প্রহসন করা হয়েছে পুরো জাতির সাথে।

ইসলাম একমাত্র জীবনব্যবস্থা, ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, কেবলমাত্র ইসলামের মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত ন্যায় ও ইনসাফ, ইসলামের মধ্যেই রয়েছে প্রত্যেকটি অপরাধের ন্যায় বিচার। এই ইসলামের দৃষ্টিতে পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্যতম অপরাধ গুলোর একটি হলো অন্যায়ভাবে নিরপরাধ মানুষ হত্যা করা, এবং তারচেয়েও ভয়াবহ অপরাধ হলো সেই হত্যার বৈধতা দেওয়া। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন, “যে ব্যক্তি মানুষ হত্যা কিংবা যমীনে সন্ত্রাস সৃষ্টির কারণ ব্যতীত কাউকে হত্যা করবে সে যেন সমস্ত মানুষকেই হত্যা করল।” (সূরা মায়েদা: ৩২)

অন্যায় ভাবে কাউকে হত্যা করা ইসলামে ভয়াবহ অপরাধ, এর শাস্তি হচ্ছে কিসাস(সমপরিমাণ শাস্তি) অর্থাৎ যে ভাবে নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে, একইভাবে হত্যাকারি ব্যক্তিকেও হত্যা করতে হবে, কিংবা নিহতের পরিবার যদি চায় তাহলে তার থেকে ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করতে পারবে। হত্যা সত্য প্রমাণিত হওয়ায় সাথে সাথেই রাষ্ট্র তার শাস্তি কার্যকর নিশ্চিত করবে যদিও হত্যাকারি খোদ রাষ্ট্রপ্রধান হয়। ফুকাহায়ে কেরাম এর মতে যদি খোদ রাষ্ট্রপ্রধান জালিম হয়, নিরপরাধ মানুষকে অন্যায় ভাবে হত্যা করে তবে বিদ্রোহের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে ন্যায়পরায়ণ কাউকে ক্ষমতায় বসানো তাদের জন্য আবশ্যক হয়ে পড়বে। ইমাম নববী (রাহিঃ) বলেন, “শাসকের বড় জুলুম ও ঘোরতর অপরাধে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ওয়াজিব।” ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিঃ) বলেন, “শাসক যদি অন্যায় হত্যাকাণ্ড চালায়, তবে তাকে কিসাসে দণ্ডিত করা হবে; শাসক হওয়া তার অপরাধ কমায় না।” অথচ আমাদের দেশের তথাকথিত আদালত শুধু তাদের ফাঁসির রায় ঘোষণা করেছে, কার্যকর হওয়া না হওয়া তাকদিরের উপর ছেরে দিয়েছে, যেমনটা ইতিপূর্বে অনেক তাগুত শাসকদের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে যাদের ফাঁসির রায় হওয়ার পরও যামিনে মুক্তি পেয়েছে। অপরদিকে প্রশাসন এবং সামরিক বাহিনী থেকে যারা সরাসরি এই হত্যাকান্ডে জরিত ছিল তাদের অধিকাংশকেই বিচারের আওতায় আনা হয়নি যেন তাদেরকে পূণরায় অপর কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডে ব্যবহার করা যায়। এছাড়াও গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবারকে সামান্য কিছু অর্থ সহযোগিতা করা হয়েছে যাতে তাদের দিক থেকে পরবর্তীতে কোনো প্রতিবাদ না তৈরি হয়। সুতরাং এটা উম্মাহর কাছে স্পষ্ট হওয়া উচিত যে, হাসিনার ফাঁসির রায় মূলত ন্যায়বিচারের নামে আবারো জাতির সাথে প্রতারণা। মুসলিম উম্মাহর সামনে সকল অপরাধের জন্য শুধুমাত্র হাসিনাকে দোষী হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে অথচ হাসিনা ছিল দিল্লি এবং ওয়াশিংটনের নিয়োগকৃত একজন গোলাম। সে ইসলামের নামে যত ধরনের দমনপীড়ন চালিয়েছে তার সবকিছুই আদেশ এসেছিল দিল্লি এবং ওয়াশিংটন থেকে। তাই উম্মাহর মূল শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে আমেরিকা ও ইন্ডিয়াকে এবং তাদের চাপিয়ে দেওয়া গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ কে। যতদিন জাতি গণতন্ত্রের মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে রাখবে ততদিন পর্যন্ত জুলুম নিপিড়নের এই ধারা অব্যাহত থাকবে। পালাবদল হবে শুধু ক্ষমতার এবং কথিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল এর ব্যানার ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক অপরাধী গোষ্ঠীকে প্রত্যেকবার নিরাপত্তা দেওয়া হবে।

ইসলামী শরীয়তে হাসিনার বিচার কেমন হওয়া উচিত?

যেহেতু হাসিনা হত্যার আদেশ কর্তা সেই হিসেবে শরীয়ত মতে সেও হত্যার উপযুক্ত। তাকেও হত্যা করতে শরীয়ত নির্দেশনা দেয়। কেননা স্বৈরশাসক হাসিনার সরকার চৌদ্দ শতাধিক মানুষকে হত্যা করেছে এবং প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষকে গুরুতরভাবে আহত করেছে। এদের অনেকেই চিরদিনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছে এবং বহু ছাত্র-জনতা চোখ ও হাত-পা হারিয়েছে। যার সাক্ষী ও রয়েছে। এই মামলায় প্রথম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গুরুতর আহত হওয়া খোকন চন্দ্র বর্মণ। এ মামলায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ মোট ৫৪ জন সাক্ষী জবানবন্দি দেন।
সেখানে আসামি থেকে অ্যাপ্রুভার বা রাজসাক্ষী হিসেবে আবির্ভূত হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের জবানবন্দিও রয়েছে ।
সুতরাং এই পরিস্থিতে ইসলামী শরীয়াতের বিধানের ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِصَاصُ فِي الْقَتْلَى ۖ الْحُرُّ بِالْحُرِّ وَالْعَبْدُ بِالْعَبْدِ وَالْأُنثَىٰ بِالْأُنثَىٰ ۚ فَمَنْ عُفِيَ لَهُ مِنْ أَخِيهِ شَيْءٌ فَاتِّبَاعٌ بِالْمَعْرُوفِ وَأَدَاءٌ إِلَيْهِ بِإِحْسَانٍ ۗ ذَٰلِكَ تَخْفِيفٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَرَحْمَةٌ ۗ فَمَنِ اعْتَدَىٰ بَعْدَ ذَٰلِكَ فَلَهُ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾

হে ঈমানদারগন! তোমাদের প্রতি নিহতদের ব্যাপারে কেসাস গ্রহণ করা বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। স্বাধীন ব্যক্তি স্বাধীন ব্যক্তির বদলায়, দাস দাসের বদলায় এবং নারী নারীর বদলায়। অতঃপর হত্যাকারীকে যদি তার ভাই (নিহতের ওলি)-এর পক্ষ থেকে কিছুটা ক্ষমা করা হয়, তবে ন্যায়ানুগভাবে (রক্তপণ) দাবি করার অধিকার (ওলির) আছে। আর উত্তমরূপে তা আদায় করা (হত্যাকারীর) কর্তব্য। এটা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এক লঘুকরণ এবং একটি রহমত। এরপর কেউ সীমালঙ্ঘন করলে সে যন্ত্রণাময় শাস্তির উপযুক্ত। [সূরা বাকারা: ১৭৮]

অন্যত্র আল্লাহ বলেন:

وَكَتَبْنَا عَلَیْهِمْ فِیْهَاۤ اَنَّ النَّفْسَ بِالنَّفْسِ وَالْعَیْنَ بِالْعَیْنِ وَالْاَنْفَ بِالْاَنْفِ وَالْاُذُنَ بِالْاُذُنِ وَالسِّنَّ بِالسِّنِّ وَالْجُرُوْحَ قِصَاصٌ فَمَنْ تَصَدَّقَ بِهٖ فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَّهٗ وَمَنْ لَّمْ یَحْكُمْ بِمَاۤ اَنْزَلَ اللهُ فَاُولٰٓىِٕكَ هُمُ الظّٰلِمُوْنَ.

এবং আমি তাতে (তাওরাতে) তাদের জন্য বিধান লিখে দিয়েছিলাম যে, প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান ও দাঁতের বদলে দাঁত। আর জখমেও (অনুরূপ) বদলা নেওয়া হবে। অবশ্য যে ব্যক্তি তা ক্ষমা করে দেবে, তার জন্য তা গুনাহের কাফফারা হয়ে যাবে। যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুসারে বিচার করে না, তারা জালেম। [সূরা মায়েদা: ৪৫]

কিসাস মাফ করার অধিকার রয়েছে কেবল নিহতের ওয়ারিসগণের। অন্য কারো নিজের পক্ষ থেকে হত্যাকারীকে ক্ষমা করার বা শাস্তি পরিবর্তন করার কোনো অধিকার নেই। কোনো রাষ্ট্রের আইনে যদি খুনিকে ক্ষমা করে দেওয়ার অধিকার রাষ্ট্রপ্রধানকে দেওয়া থাকে আর সে ক্ষমতাবলে খুনিকে তিনি ক্ষমা করে দেন, তবে দেশীয় আইনে সে ক্ষমা পেয়ে গেলেও আল্লাহর আইনে সে ক্ষমা পাবে না। আল কুরআন এই অধিকার কোনো রাষ্ট্রপতিকে দেয়নি। ইতিহাসে যে সকল সমাজে মানব রচিত আইনে বিশেষ ব্যক্তিবর্গকে এ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তার কুফল ও অশুভ পরিণামও সে সমাজ দেখতে পেয়েছে। এছাড়াও হাসিনার নির্দেশে নিহত হওয়া ব্যক্তির পরিবারের একজন ও যদি তার বিচার ও কিসাস তথা মৃতদন্ড চায় তাহলে তাকে তার মৃত্যুদণ্ড থেকে কেউ রেহাই দিতে পারে না। আর আমরা জানি যে নিহত ব্যাক্তির পরিবার সহ লক্ষ লক্ষ মানুষ তার মৃত্যুদণ্ড চাচ্ছে তাই ইসলামের বিধান অনুযায়ী তার মৃতদণ্ড কার্যকর করতে হবে। সুতরাং কোনো ব্যক্তি যদি অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে এবং নিহতের পরিবার কিসাস দাবি করে, তাহলে মুসলিম বিচারকের কর্তব্য— কুরআনের বিধান অনুযায়ী কিসাস কার্যকর করা। এক্ষেত্রে অন্য কোনো শাস্তি যেমন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, আমৃত্যু কারাদণ্ড ইত্যাদি শাস্তি প্রদানের কোনো এখতিয়ারই তার নেই। কেননা আল্লাহ তাআলা কিসাসের বিধানকেই ফরয করেছেন।

কিসাসের বিধান বর্ণনা করার পর আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَ مَنْ لَّمْ یَحْكُمْ بِمَاۤ اَنْزَلَ اللهُ فَاُولٰٓىِٕكَ هُمُ الظّٰلِمُوْنَ.

আর যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুসারে বিচার করে না, তারা জালেম। — [সূরা মায়েদা: ৪৫]

আর অন্যান্য যারা এই হত্যার সাথে জড়িত যেমন প্রশাসনের যারা সরাসরি গুলি করে বা অন্য কোন ভাবে হত্যা করেছে অথবা অন্য যে কোন ভাবে জড়িত হয়েছে তাদের ও শরীয়ত মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করেছে। তবে যাকে হত্যা করেছে তার পরিবার হত্যাকারীকে ক্ষমা করলে ক্ষমা পাবে অথবা তার মৃতদন্ডের পরিবর্তে দিয়াত (রক্তপণ) যদি গ্রহণ করতে চায় তাহলে ১০০ টি উট বা তার সমমূল্য টাকা দিয়ে সে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পাবে। তবে অবশ্যই এটা নিহত পরিবারের ইচ্ছা অনুযায়ী হবে।

এক ব্যাক্তির হত্যার সাথে যতজন জড়িত থাকবে সকলে মৃতদন্ড বলে পরিগণিত হবে।

عَنْ سَعِيدِ بْنِ الْمُسَيَّبِ: أَنَّ عُمَرَ بْنَ الْخطاب قَتَلَ نَفَرًا خَمْسَةً أَوْ سَبْعَةً بِرَجُلٍ وَاحِدٍ قَتَلُوهُ قَتْلَ غِيلَةٍ وَقَالَ عُمَرُ: لَوْ تَمَالَأَ عَلَيْهِ أَهْلُ صَنْعَاءَ لَقَتَلْتُهُمْ جَمِيعًا. رَوَاهُ مَالِكٌ

সা’ঈদ ইবনু মুসাইয়্যাব (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন ’উমার ইবনুল খত্ত্বাব (রাঃ) এক ব্যক্তির হত্যার বদলে (কিসাস স্বরূপ) পাঁচ অথবা সাত ব্যক্তিকে হত্যা করেন। তারা সংগোপনে সম্মিলিতভাবে হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিল। অতঃপর ’উমার (রাঃ) বললেন, যদি ঐ লোকটিকে সমস্ত সান্’আ-এর অধিবাসী মিলে হত্যা করত, তাহলে আমিও কিসাসস্বরূপ তাদের সকলকে হত্যা করতাম।
(সহীহ : মালিক ১৬৮৮, ইরওয়া ২২০১, মুসনাদ আশ্ শাফি‘ঈ ৩৩৩, মিশকাত ৩৪৮১)

আর কিসাস আদায়ে যারা বাধা প্রদান করবে তাদের ব্যাপারে হাদীস এসেছে,

وَعَن طَاوُوس عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «مَنْ قُتِلَ فِي عِمِّيَّةٍ فِي رَمْيٍ يَكُونُ بَيْنَهُمْ بِالْحِجَارَةِ أَوْ جَلْدٍ بِالسِّيَاطِ أَوْ ضَرْبٍ بِعَصًا فَهُوَ خَطَأٌ عقله الْخَطَأِ وَمَنْ قَتَلَ عَمْدًا فَهُوَ قَوَدٌ وَمَنْ حَالَ دُونَهُ فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللَّهِ وَغَضَبُهُ لَا يُقْبَلُ مِنْهُ صَرْفٌ وَلَا عَدْلٌ» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُد وَالنَّسَائِيّ

ত্বাঊস (রহঃ) সূত্রে ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি গোলযোগের মধ্যে নিহত হয়। যেমন- পাথর মারামারি অথবা চাবুক ছোঁড়াছুঁড়ি বা লাঠালাঠি দ্বারা গোলমাল হয়েছে- এমতাবস্থায় তাকে অনিচ্ছাকৃত হত্যা বলে ধরা হবে। আর এর দিয়াত (রক্তপণ)-ও ভুলবশত হত্যার দিয়াতের মধ্যেই শামিল হবে। আর যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করে, তখন ঐ হত্যাকারী ক্বিসাসের আওতায় এসে যাবে। আর যে ব্যক্তি কিসাস গ্রহণ করার মাঝে বাধা দেয়, তার ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত ও গজব রয়েছে। তার ফরয ও নফল কোনো ’ইবাদাতই গৃহীত হবে না।
(সহীহ : নাসায়ী ৪৭৯০, ইবনু মাজাহ ২৬৩৫, আবূ দাঊদ ৪৫৩৯, মিশকাত ৩৪৭৮ )

কিসাস দ্রুত কার্যকর করা:

যদি কাউকে হত্যা করা প্রমাণিত হয় এবং নিহত ব্যক্তির পরিবার কিসাস দাবি করে তাহলে এর কিসাস তথা মৃতদন্ড দ্রুত কার্যকর করতে হবে। এটা কার্যকর করতে দেরি করা ঠিক নয়। এতে বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। রাসূল ﷺ–এর আমলে হত্যা প্রমাণ হওয়ার পর কিসাস তৎক্ষণাৎ কার্যকর হওয়ার সহিহ হাদিস পাওয়া যায় যেমন:

হাদিস–১ : ইহুদি পুরুষ দ্বারা নারী হত্যার ঘটনা.

عَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: أَنَّ يَهُودِيًّا قَتَلَ جَارِيَةً عَلَى حُلِيٍّ لَهَا، فَقَتَلَهَا بِحَجَرٍ، فَقُتِلَ بِهَا.

অর্থ: “এক ইহুদি ব্যক্তি একটি দাসীকে তার গয়নার জন্য হত্যা করেছিল, সে তাকে পাথর দিয়ে মেরেছিল, তখন (প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হলে) তাকে সেই নারী হত্যার বদলে কিসাস করে হত্যা করা হলো।” (সহিহ বুখারি, কিতাবুদ দেয়াহ)

এখানে দেরি করা হয়নি; সাক্ষ্য প্রমাণের পরই কিসাস।

হাদিস–২ : নিজে হত্যার স্বীকারোক্তি করা ব্যক্তির কিসাস

عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ ﷺ فَقَالَ: إِنِّي قَتَلْتُ رَجُلًا، فَقَالَ النَّبِيُّ ﷺ: أَغَدًا نَقْتُلُهُ.

অর্থ: “এক ব্যক্তি এসে বলল: আমি একজনকে হত্যা করেছি। রাসূল ﷺ বললেন: ‘আগামীকাল আমরা তাকে কিসাসে হত্যা করব।’” (সহিহ মুসলিম)

প্রশাসনিক প্রস্তুতির জন্য মাত্র পরের দিন নির্ধারণ—কোনো দীর্ঘ বিলম্ব নয়।

হাদিস–৩ : পাথর দ্বারা হত্যা করা নারীর কিসাস:

عَنْ أَنَسٍ قَالَ: أَنَّ جَارِيَةً وُجِدَ رَأْسُهَا بَيْنَ حَجَرَيْنِ، فَقِيلَ مَنْ فَعَلَ هَذَا بِكِ؟
قَالَتْ: فُلَانٌ، فَأُخِذَ فَاعْتَرَفَ، فَأَمَرَ بِهِ رَسُولُ الله ﷺ فَرُضَّ بَيْنَ حَجَرَيْنِ.

অর্থ: এক নারীকে পাথর দিয়ে হত্যা করা হয়। সে মৃত্যুর আগে ইঙ্গিতে অপরাধীকে চিহ্নিত করে। ধরা হলে সে স্বীকার করে। রাসূল ﷺ আদেশ দিলেন এবং তাকে একই পদ্ধতিতে কিসাস করা হলো।

প্রমাণ প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই কিসাস।

চার মাযহাবের ফিকহী রায়:

কিসাস প্রমাণিত হলে বিলম্ব করা উচিত নয়

হানাফি মাযহাব:

কাসানী (بدائع الصنائع)

“কিসাস প্রমাণিত হলে দেরি করা অনুচিত। রাসূল ﷺ কখনো বিলম্ব করেননি।”

মালিকি মাযহাব:

ইবন জিয (القوانين الفقهية):

“কিসাস তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করা সুন্নাহ, যদি কোনো বাধা না থাকে।”

শাফিই মাযহাব:

ইমাম নববী (الروضة):

“কিসাস বিলম্ব করার কারণ নেই; প্রমাণ পরিষ্কার হলে তা দ্রুত কার্যকর করা সুন্নাহ।”

হাম্বলি মাযহাব

ইবন কুদামা (المغني):

“নবী ﷺ প্রমাণ প্রতিষ্ঠার পর কিসাস দ্রুত কার্যকর করেছেন। তাই বিলম্ব করা উচিত নয়।”

চার মাযহাব একমত:
যখন প্রমাণ নিশ্চিত, আর হত্যা হওয়া ব্যক্তির পরিবার কিসাস দাবি করে, তখন কিসাস বিলম্ব করা জায়েজ নয়—সুন্নাহ হলো তাৎক্ষণিক কার্যকর করা।

সুতরাং হাসিনা এবং গণহত্যায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত এমন সকল ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড দ্রুত কার্যকর করা হতো যদি বাংলাদেশে ইসলামী শরীয়াহ প্রতিষ্ঠিত থাকতো।

তাহলে সমাধান কোথায়?

মহান রব্বুল আলামীন ঘোষণা করেন:

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آمَنُواْ بِمَا أُنزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنزِلَ مِن قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَن يَتَحَاكَمُواْ إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُواْ أَن يَكْفُرُواْ بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُضِلَّهُمْ ضَلاَلاً بَعِيدًا

আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যারা দাবী করে যে, যা আপনার প্রতি অবর্তীর্ণ হয়েছে আমরা সে বিষয়ের উপর ঈমান এনেছি এবং আপনার পূর্বে যা অবর্তীণ হয়েছে। তারা বিরোধীয় বিষয়কে শয়তানের দিকে নিয়ে যেতে চায়, অথচ তাদের প্রতি নির্দেশ হয়েছে, যাতে তারা ওকে মান্য না করে। পক্ষান্তরে শয়তান তাদেরকে প্রতারিত করে পথভ্রষ্ট করে ফেলতে চায়। [সুরা নিসা: ৬০]

এখানে يَزْعُمُونَ শব্দ দ্বারা তাদের ঈমানের দাবিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হয়েছে, যারা আল্লাহর আইন ব্যতীত তাগুতের আইনের কাছে বিচার প্রার্থী হয়। অতএব কোন মাজলুমের উচিত হবে না এই তাগুতি আইনের কাছে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করা এমনকি তাদের কথিত ন্যায়(?) তারা প্রতিষ্ঠা করলেও সেটার প্রতি কোনরূপ সন্তুষ্টি প্রকাশ করা যাবে না। জামাআতুল মুজাহিদীন এদেশের শিরকি বিচার ব্যবস্থাকে অস্বীকার করে, এ দেশের বস্তাপঁচা সংবিধান কে অস্বীকার করে, পক্ষান্তরে শুধুমাত্র ইসলামী শরীয়াহ আদালতকে বিশ্বাস করে। শরিয়াহ আদালতের ওলামা কর্তৃক যেকোনো রায়কে তারা বেছে নেবে সন্তুষ্টচিত্তে ইনশাআল্লাহ। মাজলুমদের উপর অবিচারে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য জামাআতুল মুজাহিদীন বদ্ধপরিকর। মুসলিম তৌহিদী জনতার প্রতি আহ্বান আপনারা ইসলামী শরীয়াহ আদালত প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করুন, জালিমের জুলুমের প্রাপ্য আদায়ে নিজেদেরকে প্রস্তুত করুন ইনশাআল্লাহ। প্রত্যেকটি অন্যায় হত্যার জন্য হত্যাকারীকে শরীয়াহ আদালতের মাধ্যমেই তাদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেওয়া হবে এবং এতেই মাজলুমের প্রাপ্য হক আদায় হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন।

– শাইখ আবু আব্দুল্লাহ আল হিন্দি
মুখপাত্র জামাআতুল মুজাহিদীন

COMMENTS

WORDPRESS: 0